সাধারণভাবে একজন মানুষের বর্তমান ও সম্ভাব্য আয়ের উপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য ব্যয় (সাধারণ ও বিশেষ) এবং সম্ভাব্য সঞ্চয়ের আগাম হিসাব প্রস্তুতিকেই আর্থিক পরিকল্পনা বলা হয়। বিশেষ ব্যয় বলতে আমরা পরিস্থিতির কারণে উদ্ভূত আকষ্মিক ব্যয়কে বুঝি। যেমন: হঠাৎ অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি।
আয় বুঝে ব্যয় করাই মূলতঃ আর্থিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। আর্থিক পরিকল্পনায় বর্তমান আয় এবং সম্ভাব্য আয়ের উৎসসমূহ চিহ্নিত করা হয়। একই সাথে ভবিষ্যতে ব্যয় কী হতে পারে, কোন কোন খাতে এ ব্যয় হতে পারে তা চিহ্নিত করা হয়। একই সাথে সঞ্চয়ের বিষয়েও লক্ষ্য রাখা হয়। ভবিষ্যতে হঠাৎ অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হলে তা কিভাবে মেটানো হবে, সে বিষয়ের একটা রূপরেখা থাকে। তাই নিরাপদ ভবিষ্যত এবং আকষ্মিক চাহিদা মেটানোর তাগিদে প্রত্যেকের আর্থিক পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন।
আয় ও ব্যয়ের সঠিক পরিকল্পনাই হলো বাজেট। সঠিক বাজেট ব্যবস্থাপনা তথা আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার মাধ্যমে সঠিক আর্থিক পরিকল্পনা করা যায়। বাজেট এর ধাপসমূহ নিম্নরূপ-
· নিজ নিজ আর্থিক অবস্থার মূল্যায়ন করা;
· কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা চিহ্নিত করাসহ আর্থিক প্রয়োজনীয়তাকে বিভিন্ন মেয়াদে ভাগ করা; যেমন: স্বল্প মেয়াদ (০১ বছর), মধ্য মেয়াদ (০১ থেকে ০৫ বছর) এবং দীর্ঘ মেয়াদ (০৫ বছরের অধিক)।
· প্রতিটি প্রয়োজনের বিপরীতে সপ্তাহে/মাসে কত সঞ্চয় করতে হবে তা হিসাব করা;
· মেয়াদ অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রত্যেক প্রয়োজনের বিপরীতে অর্থ সংস্থান করা;
· নিয়মিত নিজের সঞ্চয়ের পর্যালোচনা করা এবং মাস শেষে সঞ্চয়ের হিসাব করা;
· আয়, ব্যয় ও সঞ্চয় হিসাবের জন্য আর্থিক ডায়েরি ব্যবহার করা এবং
· অনুমোদিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় করা।
এছাড়া ব্যক্তিগত বাজেট করার জন্য নিম্নোক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে-
সাধারণত: আয় হতে সব ধরণের খরচ/ব্যয় নির্বাহের পর উদ্বৃত্ত অর্থকেই আমরা সঞ্চয় বুঝি। জীবনের নানা প্রয়োজন মেটাতে বা আকস্মিক দুর্ঘটনা মোকাবিলায় আমাদের সঞ্চয় থাকাটা খুব জরুরী। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে তখন অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহের জন্য আমাদের ঋণ করতে হয় বা অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয়। এরকম পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সঞ্চয়ের কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া, জীবনের নানা টানাপোড়নে আমাদের নিয়মিত আয়ও অনেক সময় ব্যাহত হয় (যেমন: করোনাকালে চাকুরী হারিয়ে) যখন সঞ্চয়ের বিশেষ প্রয়োজন হয়। আবার প্রয়োজনীয় বিলাসদ্রব্য ক্রয় বা সন্তানের উচ্চশিক্ষার্থেও সঞ্চয়ের অর্থ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। বিশেষত:
· রোগ-শোক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মত আকস্মিক দুর্ঘটনায়;
· ফসলহানি, অগ্নিকান্ড, সংঘর্ষ ইত্যাদির কারণে;
· সন্তানের উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমন উপলক্ষ্যে;
· সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের (বিয়ে-শাদি) ব্যয় নির্বাহে;
· ধর্মীয় আচার পালনে (যেমন হজ, তীর্থ যাত্রা ইত্যাদি);
· বার্ধক্যকালে (কর্মক্ষমতাহীন অবস্থায়) ;
· প্রয়োজনীয় কিন্তু দামী ব্যবহার্য দ্রব্যাদি/মেশিনারি (ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন বা কৃষি কাজের উপকরণ ইত্যাদি) কিনতে;
· আপৎকালীন যে কোনো ঘটনা মোকাবেলায়।
জীবনধারণের জন্য প্রতিদিনের আবশ্যকীয় খরচ বা প্রয়োজনীয় ব্যয় করার পর দিনান্তে বা সপ্তাহান্তে বা মাস শেষে টাকা জমিয়ে রেখে আমরা সঞ্চয় করতে পারি। প্রতিদিন আমরা এমন অনেক ধরণের ব্যয় করে থাকি যা আপাত:দৃষ্টিতে অত্যাবশ্যকীয় মনে হলেও সেসব ব্যয় কমিয়ে আনলে আমাদের পক্ষে সঞ্চয় করা সহজ হয়। সেজন্য আমাদের প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বা কম প্রয়োজনীয় ব্যয় এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। অপ্রয়োজনীয় খরচ বলতে বিশেষতঃ ভোগের নিমিত্তে বা শখের পেছনে ব্যয় করাকে বোঝায়। এই সকল শখের বা ভোগের জিনিসগুলো বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য নয়।
তিনটি সহজ উপায়ে সঞ্চয় করা যেতে পারে :
1. খরচ কমিয়ে: বিবাহ-উৎসব, বিলাস ভ্রমণ বা আপ্যায়নে খরচের বাহুল্য কমিয়ে।
2. খরচ আপাতত না করে: অত্যাবশ্যক না হলে মটরসাইকেল, গাড়ি, স্মার্ট গ্যাজেট (নতুন ফিচার সম্পন্ন স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ ইত্যাদি) গহনা, জমকালো পোশাক ইত্যাদির জন্য আপাতত খরচ না করে এবং
3. খরচ বাদ দিয়ে: অতিরিক্ত চা পান পরিহার; পান/সিগারেট বা তামাক জাতীয় দ্রব্য গ্রহণের অভ্যাস পরিহার; শরীরের জন্য ক্ষতিকর অভ্যাসগত অন্যান্য দ্রব্যাদি সেবন বাদ দিয়ে; অপ্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার বাদ দিয়ে; দামী পোশাক বা বিলাস সামগ্রী ইত্যাদির পেছনে খরচ পরিহার করে।
সঞ্চয়ের মেয়াদ বেশি হলে কি লাভ বেশি হয়?
সঞ্চয়ের মেয়াদ যত বেশি হবে অর্থাৎ যত বেশি দিন ধরে টাকা জমানো হবে, সঞ্চয়ের পরিমাণ তত বেশি বৃদ্ধি পাবে এবং চক্রবৃদ্ধিহারে লাভের পরিমাণও বেশি হবে। স্বল্প মেয়াদী সঞ্চয়ের চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী সঞ্চয়ে লাভ তাই সবসময়ই বেশি।
আসুন সঞ্চয়ের মেয়াদ ভেদে মোট জমাসহ লাভের পরিমাণ কেমন হতে পারে সে বিষয়ে একটু ধারণা লাভ করি । ধরি একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি ২০ বছর থেকে আয় শুরু করে এবং ৬০ বছর পর্যন্ত আয় করে:
বয়স | যখন ২০ | যখন ৩০ | যখন ৪০ |
সঞ্চয়ের বছরের সংখ্যা | ৪০ | ৩০ | ২০ |
মাসিক সঞ্চয়ের পরিমাণ (টাকা) | ১,৫০০/- | ১,৫০০/- | ১,৫০০/- |
৬০ বছর বয়সে মোট সঞ্চয় | ৭,২০,০০০/- | ৫,৪০,০০০/- | ৩,৬০,০০০/- |
৬% হারে ৬০ বছর পর্যন্ত মোট পুঞ্জিভূত সুদ/মুনাফা | ২১,৫৫,৪৪৫.২১/- | ৯,২৮,৮৮৪.৭০/- | ৩,২৩,৪৬৮.৬৫/- |
৬০ বছর বয়সে মোট জমার পরিমাণ | ২৮,৭৫,৪৪৫.২১/- | ১৪,২৮,৮৮৪.৭০/- | ৬,৮৩,৪৬৮.৬৫/- |
সঞ্চয়ের টাকা রাখার নিরাপদ/লাভজনক স্থান
আমরা বিভিন্ন উপায়ে সঞ্চয়ের টাকা সংরক্ষণ করি। যেমন: আলমারিতে, মাটির ব্যাংকে, বালিশ-তোশকের নিচে ইত্যাদি। এভাবে বহুদিন টাকা রাখলে টাকা বিভিন্ন উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেমন: ইঁদুরে কাটতে পারে, বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, আগুনে পুড়ে যেতে পারে, চুরি হয়ে যেতে পারে। হাতের কাছে থাকায় ভোগ-বিলাসে বা অপ্রয়োজনে যেকোনো সময় খরচও হয়ে যেতে পারে। বাড়ীতে টাকা সঞ্চয় করলে আমরা তেমন লাভবান হবো না। কেননা ঘরে টাকা রাখার ফলে তা বৃদ্ধি পাবে না বরং কারণে-অকারণে টাকা ব্যয় বা বেহাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
টাকা সঞ্চয়ের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হলো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সাধারণত: ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাব খুলে টাকা রাখা নিরাপদ। কেননা ব্যাংকে আমানত রাখলে তা একদিকে যেমন সুরক্ষিত থাকবে, সময়ের সাথে সাথে পরিমাণেও বাড়বে (সুদ/মুনাফা সহকারে) এবং প্রয়োজনে যে কোনো সময় তা উত্তোলনও করা যাবে। এছাড়া, সরকারের বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র বা বন্ডে বিনিয়োগ করাও নিরাপদ ও লাভজনক। আবার মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলেও নিরাপদে টাকা সঞ্চয় করা যায় । আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মেয়াদি আমানত করেও টাকা সঞ্চয় করা যায় ।